হজরত দাতা গঞ্জে বখ্শ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর
সংক্ষিপ্ত জীবনী
নাম ও বংশ
পরিচয় হজরত দাতা গঞ্জে বখ্শ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর পুরো নাম শাইখ সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী হাজবিরী । কিন্তু সাধারণভাবে তিনি ‘গঞ্জে বখশ’ ও ‘দাতা গঞ্জে বখ্শ' নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন । তিনি ৪০০ হিজরিতে গজনি শহরের সন্নিকটে হাজবীর নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সাইয়্যেদ উসমান জালাবী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) । গজনির নিকটবর্তী অন্য একটি গ্রামের নাম জালাব, যেখানে হজরত সাইয়্যেদ উসমান (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বসবাস করতেন । হজরত আলী হাজবিরী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) হজরত ইমাম হাসান (রা)-এর বংশধর ছিলেন ।
হজরত আলী হাজবিরী তৎকালীন জগদ্বিখ্যাত ওলামা ও মাশায়েখের কাছ থেকে ইলমে শরীয়াত ও মারিফাত শিক্ষা লাভ করেছেন । তাঁর উস্তাদগণের মধ্য হতে হজরত শাইখ আবুল আব্বাস আশকানী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি), শাইখ আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনুল মিসবাহ সঈদলানী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি), শাইখ আবুল কাসিম আবদুল করীম ইবনে হাওয়াযিন আল-কুশাইরী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি), শাইখ আবুল কাসিম ইবনে আলী ইবনে আবদুল্লাহ আল-গুরগানী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি), আবূ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আলী আল-মারাফ দাস্তানী বুস্তামী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি), আবু সাঈদ ফাজলুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ মুহাইনী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) এবং আবূ আহমদ মুজাফ্ফর ইবনে আহমদ ইবনে হামদান (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ।
মারেফাতের দীক্ষা
হজরত শাইখ আবুল ফজল মুহাম্মদ ইবনে হাসান খাত্তালী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর ইলমে মারেফাতে মুরশিদ ছিলেন। স্বীয় মুরশিদের জীবন কাহিনি বর্ণনা করে হজরত আলী হাজবিরী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, তিনি তাফসীর, হাদীস ও তাসাউফ তিনটি বিষয়েই অভিজ্ঞ ছিলেন। তাসাউফ-এ তিনি হজরত জুনাইদ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর অনুসারী ও হজরত শাইখ হাজরামী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর মুরিদ ছিলেন। ষাট বছর অবধি তিনি জনসমাজ থেকে দূরে পাহাড়ে ইবাদতের মধ্যে নিমগ্ন ছিলেন। একবার আমি তাঁকে উজু করার সময় তাঁর হাতে পানি ঢেলে দিচ্ছিলাম, তখন আমার মনে এ খেয়াল উদয় হয় যে, আমি একটি স্বাধীন লোক, তবে কেন আমি একজন গোলামের ন্যায় তাঁর পায়ে পানি ঢেলে দিব? এ সময় আমার পীর মুরশিদ বললেন, প্রিয় বৎস! তোমার মনে যে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে, তা জানি । তবে জেনে রেখ যে, কোন কাজের সফলতার জন্য একটি মাধ্যম প্রয়োজন হয়। এ খেদমত মানুষের বুযর্গীর কারণ হয়ে যেতে পারে। এটাও খেয়াল রেখ যে, যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন তবে একজন সিপাহীর পুত্রকেও বাদশাহীর মুকুট দান করতে সক্ষম।
আধ্যাত্মিক ও রূহানী শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে হজরত আলী হাজবিরী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) সিরিয়া, ইরাক, পারস্য, কোহিস্তান, আজারবাইজান, তিবরিস্তান, খুজিস্তান, কিরমান, খোরাসান, তুর্কিস্থান এবং অন্যান্য বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন । এ সমস্ত দেশের অনেক বুযুর্গের সাথে তিনি সাক্ষাৎ করেছেন এবং তাঁদের খেদমতে থেকে রূহানী দীক্ষা হাসিল করেছেন। খোরাসানেই তিনি তিনশ মাশায়েখের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বলেন, আমি খোরাসানে এরূপ তিনশ বুযুর্গ দেখেছি, যাঁদের একজনই দুনিয়ার মানুষের হেদায়েতের জন্য যথেষ্ট ।
হজরত আলী হাজবিরী বলেছেন: আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হলে সর্ব অবস্থায় ইলমে শরীয়তের অনুসারী হতে হবে। কারণ, সুলতানে ইলম সুলতানের হালের উপর জয়ী এবং তার থেকে উত্তম হয়ে থাকে । তিনি চল্লিশ বছর ক্রমাগত বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন। তথাপি কখনও জামায়াতে নামায আদায় করা ত্যাগ করেননি এবং প্রত্যেক জুমুআর নামাযের দিন কোন শহরে অবস্থান করতেন। যখন জনসমাজে আসতেন, সাধারণ মানুষের মতো চলতেন । সুফিদের বাহ্যিক আচার-আচারণ থেকে তিনি স্বীয় মুরর্শিদের ন্যায় দূরে থাকতেন ।
বেসাল মোবারাক
হজরত আলী হাজবিরী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) স্বীয় মুরশিদের নির্দেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে সুলতান মাহমুদ গজনির পুত্র নাসিরুদ্দীন মাসউদের শাসন আমলে ১০৩০-১০৪০খ্রি: মোতাবেক ৪২১-৪৩২ হি: লাহোর আগমন করেন। এর পূর্বে তাঁর পীরভাই হোসাইন যানজানী এই কাজে নিযুক্ত ছিলেন । এজন্য যখন তাঁকে লাহোর গমনের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়, তখন তিনি স্বীয় মুর্শিদের কাছে আরজ করলেন যে, সেখানে হোসাইন যানজানী অবস্থান করছেন । সুতরাং সেখানে আমার যাওয়ার কী প্রয়োজন রয়েছে? তাঁর শায়েখ বললেন, না, তোমাকে সেখানে যেতে হবে। হজরত আলী হাজবিরী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, আমি রাতে লাহোের পৌঁছি এবং ভোরে দেখতে পেলাম যে, হোসাইন যানজানীর জানাযা শহর থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য তিনি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সফর করেছেন । তবে লাহোরই ছিল তাঁর প্রধান কেন্দ্র ।
অবশেষে ৪৬৫ হিজরিতে তিনি লাহোরেই বেসাল প্রাপ্ত হন এবং এখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়-
إِنَّ لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ -
নাসিরুদ্দীন মাসউদের পুত্র জহিরুদ্দৌলাহ তাঁর মাজার তৈরি করেন এবং তাঁর খানকাহ বাদশাহ জালালুদ্দীন আকবর (১৫৫৫-১৬০৫ খ্রি: মোতাবেক ৯৬৩-১০১৪হি:) নির্মাণ করেন। খাজা মুঈনউদ্দীন চিশতী আজমিরি (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) এবং খাজা ফরিদউদ্দীন গঞ্জে শকর (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) ফয়েজ ও বরকত লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর মাজারে চল্লিশ দিন পর্যন্ত অবস্থান করেছেন ।
হজরত খাজা মুঈনউদ্দীন চিশতী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) চিল্লা শেষে রওয়ানা হওয়ার কালে এই কবিতা আবৃত্তি করেন-
گنج بخش فیض عالم مظهر نور خدا
ناقصان را پیر کامل کاملان را رهنما
নামকরণ
হজরত দাতা গঞ্জে বখ্শ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন: “আমি এই কিতাবের নাম কাশফুল মাহজুব এই জন্য রেখেছি যে, যাতে গ্রন্থের নামে এর বিষয়বস্তু পাঠকবৃন্দ অনুধাবন করতে পারেন। বিশেষ করে, যেহেতু এই কিতাব আল্লাহর পথের বর্ণনা এবং মানুষের সামনের আল্লাহপ্রাপ্তির অন্তরায় রূপ পর্দা দূর করার উদ্দেশ্যে রচনা করা হয়েছে, এ কারণে এ গ্রন্থের নাম কাশফুল মাহজুব রাখা হয়েছে।”