• প্রথম হুজুর কেবলা হজরত মাওলানা সূফী মূফতী আজানগাছী সাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহি

    সংক্ষিপ্ত জীবনী

     জন্ম ও উপাধিঃ

           জরত মাওলানা সূফী মূফতী আজানগাছী ফারুকী (রহঃ) পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার অন্তর্গত আজানগাছী গ্রামে ১২৩৮ হিজরি মুতাবিক ১৮২৮ ইং ও বাংলা ১২৩৫ সালে জন্ম গ্রহন করেন। কিন্তু তাঁর তাঁর পিতা হজরত মাওলানা শেখ রকিবুদ্দিন ফারুকী (রহঃ), যিনি হজরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী সিরহিন্দ (রহঃ)এর পিতা হজরত শেখ আব্দুল অহাদ এর ভাই হজরত শেখ আব্দুস সামাদ ফারুকী (রহঃ) এর বংশ পরম্পরা  ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুক (রাঃ) সাথে মেলে, এবং হজরত মাওলানা আজানগাছী (রহঃ) হজরত ওমর (রাঃ) এর ৩৭তম বংশধর। হজরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী (রহঃ) এর মৃত্যু ১০৩৪ হিজরি মুতাবিক ১৬২৪ ইং তে এবং হজরত মাওলানা আজানগাছী (রহঃ) এর জন্ম ১২৩৮ হিজরি মুতাবিক ১৮২৮ইং। রেফেরেন্সের জন্য মজমুয়ে হালাত ও মাকামাতে আলফেসানী’  কিতাব টি একনজর দেখে নাও। এই দুই মহামানবের জন্মের মধ্যে ২০৪ সালের পার্থক্য। এবং এই দুই শতাব্দীতে হজরত মাওলানা আজানগাছী (রহঃ) এর পূর্বপুরুষদের মধ্যে সম্ভাবত ৮-৯ জন বুজুর্গ পর্দা নিয়েছিলেন। হজরত মাওলানা আজানগাছী (রহঃ) এর পূর্ব পুরুষেরা পশ্চিম পাঞ্জাবের সিরহিন্দ শরীফ থেকে হিজরত করে পশ্চিম বঙ্গের হাওড়া জেলার অন্তর্গত আজানগাছী গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেনএবং ওখানকার বাসস্থান গ্রহন করেন। তাঁর বংশধরের মধ্য থেকে একজন বুজুর্গ একটি গাছে উঠে আজান দিয়েছিলেন, ওই আজান যতদূর পর্যন্ত পৌঁছেছিল ওই এলাকার নাম আজানগাছী রেখেছিলেন। এই নামে বর্ণিত মাওলানা তিনি নিজের নাম গোপন করে তাঁর গ্রামের নামে খ্যাত লাভ করেন।

        ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায় আমাদের দাদাপীর আলে ফতেমা বংশে ফারুকী মীর পীরজাদা খাদেম দরগাহ ও দরবারে মদিনা মুনাওয়ারা, হাক্কানী রব্বানী কিবলা ও কাবা জাহানী ও জামানী সূফী মুফতী রকিবুদ্দিন আহমদ ফারুকী সাহেব (রহঃ) হজরত ফারুক শাহ শাহাবুদ্দিন অলী মোয়াজ উদ্দিন মহাম্মাদ ঘোরী (রহঃ) এর বংশতে মেলে। তার পরের বুজুর্গ সারা দেশ ও বাংলায় এবং অনেক জায়গায় ইসলামের ভীত কায়েম করে।

    শিক্ষা গ্রহন-

        জরত মাওলানা আজানগাছী (রহঃ) পণ্ডিত ও তাকওয়ার সাথে সাথে ধনী ও জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন। আল্লাহ্ তায়ালা প্রথম থেকেই তাঁর বংশে সায়াদাত ও শারাফাত, তাকওয়া তাহারাত অর্জনকারী বানিয়েছিলেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা নিজ পরিবার থেকেই শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁকে কলকাতা আলিয়া মাদ্রসাতে ভর্তি করে দেন। আলিয়া মাদ্রাসা লর্ড ব্যরোন ইষ্ট ইন্ডিজ ১৭৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন, সেখানে দ্বীন ও দুনিয়ার শিক্ষার তালীম দেওয়া হত। ওখানে থেকে তিনি ইলমিয়াত, ফজিলত, দাওরায়ে হাদীস, মুমতাজুল মহাদ্দেসীন ও মমতাজুল ফোকাহর পরিক্ষা পাস করে ডিগ্রি হাসিল করেছিলেন। এছাড়া তিনি যুক্তিবাদী বিজ্ঞান, পরিবহন বিজ্ঞানের সাথে সাথে আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষা গ্রহন করেছিলেন। আজকের দিনে ওই আলিয়া মাদ্রাসা নামকরন করে আলিয়া ইউনিভার্সিটিকরা হয়েছে।

        ইলমের এক পর্যায় অর্জন করার পর অন্য পর্যায় ইলমে বাতেনী অর্থাৎ রুহানিয়তের জ্ঞান অর্জনের দিকে এতটা আগ্রহী হয়ে পড়েছিলেন, তাঁকে অনেক মুশকিলের সাথে অনেক দূরের সফর করতে হয়েছিল। তাঁর পিতা তাঁকে ইলমে মারেফতের জ্ঞান অর্জনের জন্য তাঁকে প্রথম সিলসিলাহ কাদেরীয়া তরীকার বুজুর্গ ও ওলীয়ে কামেল হজরত মাওলানা শাহ সূফী মুফতী খুদা বক্স (খন্দকর) কাদেরী বাগদাদী (রহঃ) পশ্চিমবঙ্গের মেদনীপুর জেলার পিয়ার ডাঙ্গার কাছে বায়াত গ্রহন করেন। সম্ভবত ২ বছর কঠিন মেহনত, রিয়াজাত, মুজাহিদা, মুরাকাবার সাথে পূর্ণ আমল করে মুর্শিদের ফায়েজ, খিরকাহ্ ও খিলাফাত হাসিল করেছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁর মন ভরেনি যার কারনে তিনি আরও আগে বাড়তে চেয়েছিলেন, ঠিক তখনই পীর ও মুর্শিদের হুকুম হল যে তুমি বাড়ি ফিরে যাও। বর্ণিত মাওলানা ইচ্ছাপ্রশুত আদবের ভাবে জানতে চাইলেন হুজুর!কি বললেন”? জবাবে মুর্শিদ বললেন আমি আমার কাজ করে দিয়েছি সময় হলে এর ফল তুমি পেয়ে যাবে। এখন তুমি বাড়ি ফিরে যাও, তোমার পিতা ও মাতার আদেশ অনুযায়ী কাজ করবে। তাঁর পীর ও মুর্শিদ তাঁকে আজানগাছী গ্রামের মাওলানা বলে সন্মধন করেছিলেন। সেজন্য তিনি বাড়ি ফিরে গিয়ে তাঁর নিজের নাম মিটিয়ে দিয়ে গ্রামের নামে পরিচিত লাভ করেছিলেন। বাড়ি যাওয়ার পরে তিনি সর্বদা অস্তির থাকতেন। কোন কাজে তাঁর মন বসতো না, আর না খাওয়া দাওয়াতে। প্রয়োজন ছাড়া তিনি কারো সাথে কথা বলতেন না। এই অবস্থা দেখে তাঁর পরিবারবর্গ তাঁকে একজন নেককার মেয়ে দেখে বিবাহ দেন। যাতে আগের মত ঠিক হয়ে যায়, কিন্তু কোন লাভ হইনি। কিছু দিন পরে তাঁর স্ত্রী একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। তাঁর ভালোবাসা ও তাঁকে কোন পরিবর্তন করতে পারেনি। দুনিয়াদারী থেকে তাঁর মন সরতে থাকে। কোনও ভাবে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। এবাদাত করতে পছন্দ করতেন। সর্বদা তিনি আল্লাহ্‌র ধ্যনে মগ্ন থাকতেন ও বেশির ভাগ সময় মুজাহিদা, মুরাকাবা, মুশাহিদা করে কাটাতেন।

        শেষ পর্যন্ত তাঁর মনের বাসনা পুরন না হওয়ার জন্য দুনিয়ার ভালোবাসার  মোহ ত্যাগ করে ২৫ বছর বয়সে তিনি সূফীর রাস্তায় চলতে শুরু করেন। বিভিন্ন তরীকার শাইখ ও বুজুর্গের খিদমত করতেন ও ইলমে মারেফতের জ্ঞান ও কামেলিয়ত অর্জন করার জন্য তিনি আরও বিভিন্ন জায়গায় তিনি সফর করেছিলেন। পরে তিনি ফরজ হজ্জ আদায়ের উদ্দেশে তিনি রওনা দিয়েছিলেন। হজ্জ করার পরে অনেক দিন পর্যন্ত খানায়ে কাবা ও মদীনা শরীফের কাছে থেকে এবাদাত, রিয়াজাত এবং মুজাহিদা ও মুরাকাবা মশগুল ছিলেন। ওখনেই তিনি হজরত মাওলানা হাজী শাহ সূফী দীন মহাম্মাদ মাক্কী আরজি সাদেকী হাসায়েনী ও হোসায়েনী (রহঃ) (মোয়াল্লেম হেরেম শারীফ) এর কাছে বায়াত গ্রহন করেন। তাঁর কাছে থেকে খিরকাহ্ ও খিলাফাত লাভ করেছিলেন। সেখানে থেকে পীর ও মুর্শিদের হুকুম নিয়ে অন্য জায়গায় সফর করলেন ও সেখানের কামেল ওলীর কাছে থেকে খিদমত ও সহবত অর্জন করলেন। এমন করে তিনি তাঁর ইচ্ছা পূরন করার উদ্দেশে এক মুর্শিদের হুকুম নিয়ে অন্য মুর্শিদের খিদমত করে তাঁর কাছে থেকে তাসাওয়ুফের সাথে ইলমে বাতেনীর জ্ঞান অর্জন করেছেন। এমন করে তিনি সমস্ত কামেল মুর্শিদের কাছে থেকে খিরকাহ্ ও খিলাফত এবং ইজাজাত পেয়েছিলেন। তাঁহার মুর্শিদগণের মধ্যে নিয়ে কয়েকজনের নাম দেওয়া হইল যাহাদের কাছ থেকে তিনি খেলাফত্ পেয়েছিলেন।

    ১। হজরত শাহ সূফী হাফেজ হাজী এমদাদ উল্লাহ মোহাজেরে মক্কী  আল ফারুকী (রহঃ)(ইমাম এমদাদীয়া তরীক্বা)

    ২। হজরত শাহ সূফী ফজলুর রহমান গঞ্জে মোরাদাবাদী (রহঃ) (নকশেবন্দীয়া তরীক্বা)

    ৩। হজরত শেখ শাহ সূফী মাওলানা হাজী দীন মোহাম্মাদ মক্কী আরজি সাদিক আল্ হাসায়েনী হুসাইনী (রহঃ)(মোজাদ্দেদীয়া তরীক্বা)

    ৪। হজরত শেখ শাহ সূফী মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মাদ গাজী (রহঃ) (চিশতীয়া তরীক্বা)

    ৫। হজরত শেখ শাহ সূফী মাওলানা ওবেদ উল্লাহ (রহঃ) এই দুইজন মুর্শিদ হজরত মাওলানা সূফী সাবাদী আখুঞ্জি/সবাদ অখুন্দ (রহঃ)এর মুরিদ ও খাদেম ছিলেন। এইভাবে তিনজনের মাজার ওখানেই দাফন করা হয় গাঞ্জে শাহিদতে।

    ৬। হজরত শেখ শাহ সূফী খন্দোকার খোদাবক্শ মিয়া (রহঃ) (কাদেরীয়া তরীক্বা)

    হজরত শেখ শাহ সূফী মাওলানা খন্দোকার খুদী মিয়া (রহঃ) (কাদেরীয়া তরীক্বা)

    ৮। হজরত শেখ শাহ সূফী মাওলানা খোন্দকার মনছুর আহাম্মেদ (রহঃ) (কাদেরীয়া তরীক্বা)

        তিনি এই সমস্ত ওলী আল্লহর খিলাফাত লাভ করার পরে পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার সুঁড়ির জঙ্গলে দীর্ঘ ১৪ বছর পর্যন্ত কঠিন সাধনা করেছেন। বর্তমানে ওই জঙ্গল জনবাসতিতে পরিপূর্ণ বাগমারী নামে পরিচিত। ওখানেই তাঁর মাজার মোবারক অবস্হিত।

        এই ১৪ বছর জঙ্গলে তিনি দিনে রোযা ও রাতে এবাদাতে ইলাহির মশগুল থাকতেন। আল্লাহ্‌র ধ্যানে এমন ভাবে তিনি মশগুল থাকতেন যে একমুঠো ছোলাতে সেহেরী ও নীম পাতার পানি দিয়ে ইফতারী করে তিনি তাঁর নফসকে দমন করতেন। কোন এক ব্যাক্তি বলেন, ওখানেই তিনি খিজির (আঃ) এর সাথে মোলাকাত হয়েছিল। জঙ্গলে থাকার জন্য তিনি সপ্তাহে একবার জুম্মার দিনে বাহির হতেন। জুম্মার নামাজ আদায় করে তিনি এবার ফিরে আসতেন। এমন ভাবে তিনি আল্লাহ্‌র ভালোবাসা পাওয়ার জন্য নিজেকে বিলীন করে দিলেন। কেও একজন সত্য বলেছেন-

    আহলে ওফা কে নাম কি হাস্তী সে নাঙ্গ হো

    লৌহে মাজার ভি মেরী ছাতী পে সাঙ্গ হো

    অর্থ- আল্লাহর ওলীর জন্য নিজের নামের অস্তিত্ব লজ্জাজনক,

    কবরের নামফলকও বক্ষের উপর প্রস্তরসম।

       চৌদ্দ বছর জঙ্গলের জীবন শেষ হওয়ার পরে যখন তিন লোকালয়ে এলেন হজরত মাওলানা আজানগাছী (রহঃ) বাস্তবতায় তিনি ওয়ারিসে নবুওয়াত হয়ে আত্ম প্রকাশ করলেন। অবিভাবক হয়ে তিনি প্রকাশ করলেন। হেদায়েতের আলো হয়েই তিনি প্রকাশ হলেন। ফানা ফিল্লাহ ও বাকা বিল্লাহর উচ্চ স্থানে পৌঁছে সত্য পথ প্রদর্শক হয়ে ইসলামের পক্ত কামেল নেতা হয়ে ফিরে এসে দাওয়াতে তাবলীগের কাজ শুরু করেন। কিছুদিন পরে তিনি আবার কলকাতা ফিরে এসে কলাবাগান জামে মসজিদে প্রতি জুম্মার নামাজ আদায় করতে যেতেন ওখানেই তিনি দাওয়াতে তাবলীগ করতেন। হজরত মাওলানা আজানগাছী (রহঃ) ইসলামের দাওয়াতের সাথে নামাজ, ওজিফা, হালাল রুজি, সুদ ও হারাম খাদ্যের,তাকওয়া পরহেজগারীর ফজিলত ও প্রয়োজনীয়তা বায়েন করতেন। সুদের নিষেধাজ্ঞা, ভয়াবহতা ও পাপের থেকে লোককে সবধান করতেন। এজন্য কিছু লোক তাঁকে পছন্দ করতেন না রেগে থাকতেন। এজন্য কিছু দিন রাজাবাজারের কাছে একটি ছোট ঘর ভাঁড়া নিয়ে থাকতেন। একদিনের ঘটনা, তিনি লোকেদের হাক্কানী ওজিফা শেখাচ্ছিলেন এমন সময় দুই ব্যক্তি বুদা ও পেরুমদের নেশায় আসক্ত হয়ে এসে হুজুর কেবলার মাথায় আঘাত করে মাথা ফাটিয়ে দিলেন। রক্ত বাহির হয়ে জখম হয়ে গেল। হুজুর কেবলা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে নিজের কামরাতে প্রবেশ করলো ও সিজদাতে লুটিয়ে পড়ে চিৎকার করে দোওয়া করতে লাগলো ইয়া আল্লাহ!আপনি আমাকে ক্ষমা করো ও এই দুই ব্যক্তিকে ক্ষমা করো যারা আমাকে মেরেছে। এরা আমাকে জানেনা ঠিক ওই সময় বাড়ির মালিক ছুটে এসে মদ্যকার দুই ব্যক্তির ধরে নিয়ে হুজুর কেবলার কাছে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন ও জিজ্ঞাসা করলেন তোমরা কি এই ফকিরের মেরেছো? এই দেখ! এই ফকীর তোমাদের জন্য দোয়া করছে। তোমরা ক্ষমা চেয়ে নাও। তারা দুজন ঘর মালিকের কথা শুনে ক্ষমার উদ্দেশে হজরতের কাছে গেলেন ও তিনি তাদেরকে মাফ করে দিলেন। পরবর্তীতে তারা দুই জন বিশেষ মুরিদ ও দরবারের খাদেম হয়ে গেলেন। এই কথা যখন শহরে ছড়ালো ততক্ষণাৎ শহরের গুন্ডা ও বদমাশগুলি হজরতের কাছে এসে তওবা করে নিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও ওজিফা পড়তে শুরু করলো। হালাল খাদ্য অন্বেষণ করতে লাগলো ও পাক্কা মুরিদ হয়ে গেল।



    Leave a Reply

    Subscribe to Posts | Subscribe to Comments

  • - Copyright © Haqqani Anjuman - Powered by Blogger - Designed by Rashidur Rahaman -